সে বসন্ত আসে, জোছনাতে মিলন

  • সে বসন্ত আসেনি, জোছনাতে মিলন
    হাসিনা আকতার নিগার

    আবেগী অনামিকার চোখের নোনা জল শুকিয়ে গেছে। শুধু শুকায়নি হৃদয়ের ক্ষত। ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে জীবন কাটাবার জন্য অপেক্ষার সে স্মৃতি নিয়ে আজো দিন কাটে তার। অথচ ভালোবাসার স্বপ্ন তার কাছে অধরা রয়ে গেল সারাজীবন।

    কাব্য সাহিত্য পাগল অনামিকার সাথে জয়তুর পরিচয় ভার্সিটিতে। অনামিকা বাংলার আর জয়তু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। এক ডিবেটে পরিচয় দুজনের। জয়তু যেদিন অনামিকাকে দেখে সেদিন সরাসরি বলে -
    আপনি কি আমার স্বপ্নের নায়িকা?
    অনামিকা কিছুটা হোঁচট খেয়ে বলে
    - আমি কেন আপনার স্বপ্নের নায়িকা হবো।
    জয়তু বলে - সেটাই ভাবছি।কল্পনার তুলিতে যাকে এঁকেছি সে যে বাস্তবে আছে ভাবতেও পারিনি।
    জয়তুর মোহনীয় কথায় অনামিকা বলে - বাহ শুধু ভালো তার্কিক নন আবার কাবিক্য ও বটে।
    এমন আলাপের ছলে জয়তু অনামিকার বন্ধু হয়ে উঠে। ক্লাশ শেষে চলত তাদের সাহিত্য আলাপ। এমনি করে তারা কবে যে ভালোবাসার জালে বন্দী হয়েছে কেউ জানে না। তবে " আমি তোমাকে ভালোবাসি" - কথাটি কেউ কাউকে বলেনি কোনদিন।
    বন্ধুদের কাছে জয়তু অনামিকা দারুন জুটি। প্রেমের তরীতে বাস্তবতার ছোঁয়া পেতে তাদের জীবনটা কেমন যেন পালটে গেল।

    পাশ করে দুজনেই চাকরি জীবনে ঢুকে। কত প্ল্যান দুজনের ছিল এক সাথে পথ চলা নিয়ে। তবে অনামিকা শুধু বলত বিয়ে করবে সে বসন্তের প্রথম দিনে। এটা শুনে জয়তু মুচকি হাসত আর বলত
    - আমার বাস্তবের নায়িকাকে সাজাবো সেদিন হলুদ গাঁদা আর লাল শিমুলে। তারপর হারিয়ে যাব দুজন সাগর পাড়ে। খুঁজে পাবে না কেউ আমাদের।

    কদিন বাদে বসন্ত আসছে। কিন্তু অনামিকা জয়তুর সে বসন্ত আসেনি জীবনে আর আসবেও না হয়ত কোনদিন। তবু অনামিকা অপেক্ষা করে সে দিনটির জন্য। কেন জয়তু তার সব স্বপ্ন এভাবে মিথ্যে করে দিলো? বড় ইচ্ছে হয় অনামিকার জানতে। কিন্তু জয়তু কোথায় আছে তা জানে না অনামিকা। সে যে ইচ্ছে করে হারিয়ে গেছে অনামিকার জীবন থেকে।

    আর কদিন পর তাদের সর্ম্পকের ২৬ বছর হবে। অনামিকা পারেনি জয়তুকে ভুলে যেতে। তাই আজ সে বাবা মাকে ছেড়ে নির্বাসিত হয়েছে সাগর পাড়ের এক গ্রামে এনজিও এর চাকরি নিয়ে।

    ভালোবাসার ৬ টি বসন্ত যেবার তখন জয়তু এসে অনামিকাকে বলেছি - আর কটা দিন অপেক্ষা করো প্লিজ। নিজেদের সবটা গুছিয়ে নিয়ে সামনের ফাল্গুনে আমরা শুরু করবো নতুন জীবন। অনামিকা বিশ্বাস করেছিল জয়তুকে। আর সে বিশ্বাসের দাম দিতে গিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সব কিছু থেকে। যাপিত জীবনে বয়ে বেড়াচ্ছে জয়তুর স্মৃতি।

    কিছু সময় নিয়ে জয়তু বিদেশ যায় অফিস থেকে পোষ্টিং নিয়ে। অনামিকার মন কেন জানি সেদিন সায় দেয়নি জয়তুর এ বিদেশ যাওয়াকে। শুধু বলেছিল
    - জয়তু আমরা কি আমাদের হারিয়ে ফেলছি বাস্তবতার কাছে।
    জয়তু খুব জোর দিয়ে বলেছিল
    - না। পৃথিবীতে অনামিকা জয়তুর।কি করে তুমি হারাবে আমাকে।অপেক্ষা করো প্লিজ।

    মিথ্যা সবটাই মিথ্যা। যে জয়তুকে অনামিকা চিনতো সে কেমন যেন পালটে যেতে থাকে বিদেশ গিয়ে। প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল। ৩/৪ মাস পর যোগাযোগ কমতে থাকে জয়তুর। অনামিকা অপেক্ষা করতে থাকে ফোনের কিংবা কল করলে ফোন ধরে না জয়তু। ১০/১৫ বার কলের পর বলে এখন কথা বলা যাবে না। সময় হলে সে কল দিবে। জয়তুর সময় হয় না আর। কত রাত জেগে কাটিয়েছে অনামিকা সে হিসাব রাখেনি জয়তু।

    এমনি করে সময়ের সাথে সাথে জয়তু সরে যায় অনামিকার জীবন থেকে কোন কিছু না বলে। একদিন সে বুঝতে পারে জয়তু ফোন নাম্বার বদলে ফেলেছে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় অনামিকার সে বসন্ত আর আসে না।

    তারপর ও অনামিকার মনের কোনে বসত করে আছে জয়তু। পারে না সে ভুলে যেতে তার জয়তুকে। আর পারবে না বলেই চেনা জগতের বাইরে সাগর পাড়ে আড়াল করেছে জয়তুর অনামিকা নিজেকে।
    পূর্নিমার আলোতে সাগরের উন্মত্ততা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন জোছনার আলোতে প্রিয়ার সাথে মিলনের আকুলতা চারদিকে। অনামিকাকে এমন প্রকৃতি শুধু ব্যাকুল করে। মনে হয় একবার যদি জয়তুকে দেখতে পেত জীবনের এ বেলাতে। শুধু জানতে চাইতাক কেন সে কথা রাখেনি? এমন ভাবনাতে কখন যে ভোরের আলো ফুটেছে টের পায়নি অনামিকা।
    মহুয়া চায়ের কাপ নিয়ে এসে বললো- দিদি কার জন্য তোমার এত কষ্ট? আজও তুমি সাগর দেখে রাত পার করেছ।

    অনামিকা খুব রাগত চোখে বলে - পাকামি করছিস আবার। যা নাস্তা রেডি কর। অফিস যাবো। আজ এক বিদেশী আসবে এনজিওতে বাচ্চাদের দেখতে।

    অনেক দিন বাদে কেন জানি অনামিকার আজ শাড়ী পরতে মন চাইলো। হালকা সাজে কপালে টিপ আর তাঁতের শাড়ি পরে নিজেকে অন্য রকম মনে হলো অনামিকার।
    চঞ্চল মনটাকে স্থির করে অফিস গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজে। যিনি আসছে তার সম্পর্কে আগেই জেনেছে অনামিকা। নাম দেখে বুঝেছে ভদ্রলোক বাংগালী । তিনি দেশের ছিন্নমূল শিশুদের জন্য কিছু কাজ করতে চান। আর সে কারনে অনামিকার এন জিওতে আসছে। ভদ্রলোকের নাম জয়দীপ রহমান। নামটা দেখেই মনে পড়ল জয়তুর আসল নাম এটা। এক পলকে মনে হয়েছিল জয়তু কি তবে এ ভদ্রলোক। না তা কি করে হয়।
    এসব ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেল গাড়ির শব্দ। কিন্তু অনামিকা যেন সে শব্দে কেঁপে উঠল। মনে হল একটা ঝড়ের বাতাস বইছে। কেন এমন হচ্ছে তার আজ। কতজনই তো আসে। এমন তো হয়নি কোন দিন।নাকি এ নামটা তাকে মিথ্যা আশা জাগাচ্ছে?
    লায়লা দরজায় এসে দিদি বলে ডাকতেই অনামিকা মাথা তুলে তাকায়। আর তখনই তার দৃষ্টি যেন পাথর হয়ে যায়। এ কাকে দেখছে অনামিকা? জয়দীপ রহমান তারই জয়তু। আর জয়তুও অপলক নয়নে দেখছে অনামিকাকে। শায়লা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বিষয়টা। তাই আবার বলে - দিদি উনি জয়দীপ রহমান।
    শায়লার কথাতে অনামিকা আপন মনে বলে উঠে -
    শায়লা উনি জয়দীপ রহমান আমি জানি।
    এক মুহুর্তে অনামিকা বদলে গিয়ে ফিরে আসে আপন ভুমিকায় আর জয়দীপকে আসার জন্য স্বাগত জানিয়ে বসতে বলে। জয়তু অবাক হয়ে দেখছে ২৬ বছর আগের অনামিকার পরির্বতন। এনজিও এর বাচ্চা আর তাদের কার্যক্রম নিয়ে কত সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করছে সব। জয়তু যে তার কাছের মানুষ সে আবেগর কোন ছাপ নেই চোখে মুখে।

    অফিসের কাজ শেষে অনামিকা বাড়ি ফিরে যায় আর জয়তু হোটেলে। দুজনের মনে তীব্র ঝড়। বিধাতার একি খেলা। আজ দুজন এত কাছে কিন্তু পারছেনা কেউ কারো হাত ধরতে কিছু কথা বলতে।

    জয়তু সূর্যাস্ত দেখবে বলে সাগর পাড়ে যায়। সাগরের কাছে গিয়ে পড়ন্ত বিকালে কনে দেখার আলোতে সে দেখে অনামিকা সেখানে বসে আছে। মনে হলো অনেক হয়েছে অনামিকার কাছে এবার ক্ষমা তার চাইতে হবে আর সেটা এখনি। কতকাল আর সে এ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে।

    চুপচাপ বসে থাকা অনামিকার পাশে গিয়ে জয়তু কিছু না বলেই হাতটা ধরে অনামিকার।

    না অনামিকা পারেনি জয়তুকে বাধা দিতে। বেশ কিছু সময় নির্বাক কেটে যায় দুজনের। নীরবতা ভেংগে জয়তুই বলে -

    অনামিকা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি কথা রাখিনি তোমার।
    কথাটা শুনেই অনামিকা নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি। এক ঝটকাতে হাত সরিয়ে বলে

    -কিসের ক্ষমা চাইছো তুমি? কি অপরাধে আমার বিশ্বাস নষ্ট করে দিলে? দেখো বিধাতা ঠিক তোমাকে আমার মুখোমুখি করে দিয়েছে উত্তরটা জানিয়ে দিতে।

    জয়তু বলে - অনামিকা তুমি সেই আগের মত রেগে গেলে এক নাগাড় কথা বলে যাও। কিন্তু আমি ও চেয়েছি ক্ষমা চেয়ে আমার অপরাধটুকু তোমাকে বলতে। তাই আজ হয়ত এখানে আমি।

    অনামিকা একটু শান্ত হয়ে বললো
    - বলো তোমার কি বলার আছে।
    জয়তু জানালো তার নিজের কাছে হেরে যাওয়ার কথা। কেন সে অনামিকার সে বসন্তে আসেনি।
    বিদেশে সে এক ভুল করে। যার দায় বয়ে নিয়ে আজও সে অনামিকার মত একা। সেখানে রূপা তার অফিস কলিগ ছিল। বিদেশে জন্ম হলেও বাংগালী হিসাবে তাদের মাঝে সখ্যতা গড়ে উঠে। রূপা জানত অনামিকার কথা। জানত কতটা প্রতীক্ষা নিয়ে অনামিকা আছে। এক ছুটির দিনে রূপা জয়তু বেড়াতে যায় এক সী বিচে। আর সেখানেই জয়তু হারিয়ে ফেলে তার অনামিকাকে। বিকেল তাদের ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু স্নোর কারনে তাদের ফেরা সম্ভব হয়নি বলে রাতে হোটেল থাকে। রূপা আর জয়তু সে সন্ধ্যায় হালকা নেশায় নিজেদের আবেগকে সংযত করতে পারেনি। রূপার জয়তুর কাছে না বলা ভালোবাসাটা সেদিন প্রকাশ করে নিজেকে সমর্পণ করে।
    জয়তুর যখন নেশার আবেশ কাটে তখন সে বুঝতে পারে অনামিকার দেয়া কথা সে রাখতে পারেনি।

    জয়তু শুধু অনামিকার আর অনামিকা শুধু জয়তুর দেহ মনে এমন প্রতিজ্ঞা ছিল তাদের।আর সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি বলে ফিরে আসেনি জয়তু অনামিকার কাছে । কিন্তু রূপাকে সে বলেছে ভুলের দায় যা খুশি করতে পারে কিন্তু অনামিকা ছাড়া আর কেউ তার জীবনে নেই। রূপা বিষয়টাকে দুজনের ভুল মনে করে। তাই জয়তুকে আর কোনদিন এ নিয়ে কিছু বলেনি। সে আছে তার আপন জীবনে।

    জয়তুর কথাগুলো নীরবে শুনে অনামিকা আর নিঃশব্দে চোখের জল বয়ে পড়ে।
    জয়তু অনামিকার দিকে তাকিয়ে বলে -
    এবার তোমার ইচ্ছা আমাকে ক্ষমা করবে কিনা? আমি ২৬ বছর অপরাধী হয়ে নিজেকে নিজে শাস্তি দিচ্ছি। এখন আমার পড়ন্ত বেলাতে তাই চেয়েছি নিজের যা আছে তা এই বাচ্চাদের দিয়ে বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হতে।

    বিদায়ের কথা বলতেই অনামিকা জোরে বলে উঠে -
    আর কোন জায়গা পেলে না। শেষ বেলাতে আমার এখানে এলে নিজের সম্পদ দান করে মহান হতে। আজ ক্ষমা চাইছো। কেন ২৬ বছর আগে পারোনি বলতে এ কথাগুলো। দেখতে বলে আমি সেদিনের ভুলকে ক্ষমা করতাম কিনা।

    জয়তু বলে - ভয় ছিল মনে। যদি তুমি আমাকে ঘৃণা করতে। আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই নিজেকে আড়াল করেছি।

    দিনের আলো নিবে জোছনার আলোতে সাগরের শব্দে জয়তুর হাত ধরে অনামিকা কান্নাতে মুছে যায় তার সব কষ্ট।

    অনামিকা শুধু বলে - জীবনের বাকি কটা দিন তুমি কি থাকবে আমি আর আমার এ ছোট ছোট অসহায় বাচ্চাদের সাথে?
    জয়তু অনামিকাকে আলিঙ্গন করে বলে - সে বসন্তে আসেনি কিন্তু জোছনাতে তুমি হলে আমার, শুধু আমার।

Comments

2 comments