জীবনের কথা গল্প হলো


  • জীবনের কথা গল্প হলো
    হাসিনা আকতার নিগার

    গল্প থেকে জীবন হয় নাকি জীবন থেকে গল্প? ন হন্যতে বইটা শেষ করে ভাবতে থাকে তিথি। এ বইটা এতবার পড়ে তবুও যেন মনে হয় এই প্রথমবার পড়ছে। সত্যিকারের প্রেম অনেক বেশি শক্তিশালী। সে মিলনে হোক আর বিরহেই হোক।

    ভাবনার রেশ কেটে যায় ফোনের শব্দে। সাগরের ছবিটা স্ক্রীনে দেখতেই তড়িঘড়ি করে ফোন ধরে। হ্যালো বলার আগেই সাগর বলে উঠে -
    কোন ভাবনাতে ডুবে ছিলে? মনে আছে আজ কি কাজ?
    তিথি - তুমি কি করে জানলে আমি কিছু ভাবছি। আর কাজ মনে আছে মিঃ।
    সাগর খুব ভাব নিয়ে বলে - তোমাকে বুঝি বলেই আমি চোখ বন্ধ করে অনেক দূরে থেকে বলতে পারি তুমি কি করছো।
    তিথি - কচু বুঝো আমাকে। কদিন বাদেই বুঝবো কতটা পারো তুমি। রাখি ফোন। রেডি হয়ে বের হতে হবে না। দেখা হচ্ছে।বাই।

    সাগর তিথির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। ৪ বছরের প্রেম তারপর পারিবারিক সম্মতিতে আয়োজন চলছে বিয়ের। তারা দুজনেই বাবা মায়ের এক সন্তান। অনেকটা স্বাধীনচেতা পরিবেশে বড় হয়েছে বলেই দুই পরিবারই মেনে নিয়েছে তাদের প্রেমের সম্পর্ককে।ধর্ম বাধা হয়নি। সাগর মুসলিম আর তিথি হিন্দু। সব কিছু ঠিকঠাক হলেও তিথির মনে কেমন একটা সংশয়।শুধু মনে হয় এত সুখ কি সইবে তার।

    সাগর আর তিথি আজ বিয়ের কিছু টুকিটাকি কেনা কাটা করতে বের হয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকা হিসাবে আজই শেষ দেখা। সামনের রবিবার বিয়ের দিন দেখা হবে বর কনের সাজে। সাগর খুব গম্ভীর হয়ে আছে। তিথি বিষয়টা লক্ষ্য করেছে শপিংমলেই। সব কাজ সেরে রেষ্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়ে সাগর চুপ দেখেই তিথি বলে - বাবা বিয়ের আগেই এত মুড। এরপর কি হবে ভগবান!

    কথাটা লুফে নিয়েই সাগর বলে - সত্যি কি হবে রে। প্রেমের দিনগুলো মিস করছি। প্রেমিকা বউ হলে নাকি প্রেম কমে যায় শুনেছি। এই চিন্তাতে মনটা ভালো নেইরে। তিথি তুমি কি বউ হয়ে বদলে যাবে?
    তিথি বলে, যদি এ প্রশ্ন আমি করি কি উত্তর দেবে? তবে আমি বলব, সময় বলে দিবে সব।

    সাগর কিছু আর বলে না। প্রসংগ পালটে যায়। কি করে থাকবে আর ৫ দিন দেখা না করে। বাড়িতে আত্মীয়রা আসতে শুরু করবে। ফোন আলাপের সুযোগ থাকবে না।কিন্তু সাগরের আবদার সবার আগে তিথিকে বউয়ের সাজে সে দেখতে চায়।

    তিথি জানে সাগর কোন দুষ্ট ফন্দি করবে। তাই বার বার সাবধান করছে এমন কিছু না করতে । যা দিয়ে সবার কাছে লজ্জা পেতে না হয়।

    সকাল থেকে তিথির বাড়িতে ব্যস্ততা। আকদ হয়ে গেছে। রাতে অনুষ্ঠান বিয়ের। এজন্য সন্ধ্যা ৭টায় যেন পার্লার থেকে হোটেলে চলে যায় তা স্মরণ করে দিচ্ছে তিথির বাবা । সময়ে নিয়ে উনার বাড়াবাড়ি লেগেই থাকে। লেট করা যাবে না। এদিকে সাগর বার বার ফোন করছে তিথি কোন পার্লারে যাবে কখন যাবে কত সময় লাগবে এসব জানাতে। তিথির সন্দেহ হয় সাগরের এসব জিজ্ঞাসাতে। সাগর বলেছিল, চলো একই পার্লারের জেন্টস ফিমেল সেকশনে দুজনে সাজি। তাহলে তোমাকে আমার দেখা হবে । তিথি বলেছে সেজেই ছবি দিবো, কেন সামনাসামনি দেখতে হবে। সামনাসামনি দেখা হবে বিয়ের আসরে। এর আগে না।

    ঠিক সময়ে তিথির সাজা শেষ। লাল বেনারসি আর সাগরের মায়ের গহনাতে তিথিকে অপূর্ব লাগছে। কটা ছবি তুলে সাগরের ইন বক্সে সাথে সাথেই তিথি দিয়েছে। এরপর নিয়ন আলোতে সাজানো হোটেলের বিয়ের আসরে তিথি চলে আসে। সবাই বউ সাজে তিথির প্রশংসা করছে। কিন্তু তিথির চোখ অপেক্ষা করছে সাগরকে বরবেশে দেখতে। আসলে সে ও মনে মনে সাগরকে বিয়ের দিন দেখতে কেমন লাগবে তা নিয়ে কল্পনার ছবি এঁকেছে।

    বর আসার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অতিথিরা বুঝতে পারছে না কিছু। তিথির বাবা বারবার ফোন করছে সাগরের বাবাকে। কিন্তু ফোন ধরছে না। তিথি পাচ্ছে না সাগরকে ফোনে। এমনকি তিথির বউ সাজের ছবি গুলো আনসিন। তিথি ভাবছে সাগর বলছে নিজের চোখে সামনাসামনি তাকে দেখবে তাই হয়ত ছবি দেখেনি।

    রাত প্রায় ১০টা। ঝলমলে বিয়ের অনুষ্ঠানে পিন পতন এক নীরবতা নেমে আসে। তিথির বাবা মা বুঝতে পারে না কি করবে এখন। ঠিক সে সময় বিধবস্ত ভাবে সাগরের বাবা মা এসে করজোড়ে ক্ষমা চায় তিথির মা বাবার কাছে। আর বলে - আমরা পারব না তিথি মায়ের জীবন নষ্ট করে দিতে। মুহুর্তে কথাগুলো শুনে ষ্টেজ থেকে ছুটে আসে তিথি। শুধু বলে - কি অপরাধে এ শাস্তি আমার?

    সাগরের মায়ের চোখে জল। উত্তর নেই তার কাছে। সাগরের বাবা নিজেকে সামলিয়ে বলে - তিথি মা দোষ আমাদের ভাগ্যের। তোকে আমি ঘরের বউ করতে পারছি না রে।

    তিথি নিজেকে শক্ত করে বলে - সাগর কোথায়। সে এসে বলুক যা বলার।

    তখনি সাগরের বন্ধু অনিমেষ বলে - তিথি সাগর হাসপাতালে। সে নিজে সাজতে যাবার আগে তোমাকে দেখবে বলে তোমার পার্লারে ওখানে যায়। পার্লারের ওপারের রাস্তায় অপেক্ষা করছিল তোমার জন্য। পার্লার থেকে তুমি বের হবার আগে একজন সেজে বের হয়েছে। তাকে দেখে সাগর তুমি ভেবে তড়িঘড়ি করে রাস্তা পার হতে যায়। আর তখনি শেষ হয়ে যায় সাগরের সব স্বপ্ন।

    তিথির কথাটা শুনতেই খেয়াল হলো পার্লারের বিউটিশিয়ান তখন তার চোখ সাজাচ্ছিল। পার্লারে সবাই বলাবলি করছিল রাস্তায় একজনের এক্সিডেন্ট হয়েছে। কিন্ত সে যে তার সাগর এটা বুঝতে পারেনি।

    তিথি বলে - অনিমিষ আমাকে নিয়ে চল সাগরের কাছে।

    দীর্ঘ সময় ধরে অপারেশনের পর ডাক্তার বলে ৭ দিন পর বুঝা যাবে সাগরের কি অবস্থা হয়। ৭ দিন হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যায়নি তিথি।

    আজ ডাক্তার সাগরের চোখের ব্যান্ডেজ খুলবে। তিথি সহ সবাই অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্য। সাগরের হাত ধরে বসে আছে তিথি।কিছু সময় পর ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ কেটে দেয় আর সাগরকে চোখ খুলতে বলে।

    কিন্তু এ কি সাগর কেন বলছে তিথিকে চলে যেতে। তিথি বার বার বলছে - সাগর কেন আমি চলে যাবে। তুমি দেখছ না আমাকে। সাগর তুমি চুপ কেন?

    সাগর চোখ খুলে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এটা বুঝতে আর বাকি রইল না কারো। সাগর তিথির থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে - আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার আলোহীন পাথর দৃষ্টির জীবনে তোমার ভালোবাসা আমি একা বয়ে বেড়াব। তিথি তুমি যাও।

    তিথির দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। সে সাগরকে বলে - তুমি আমার দৃষ্টি দিয়ে দেখবে। সময় বদলে গেলে ভালোবাসা বদলে যায় না। সাগরকে ছেড়ে তিথি কোথাও যাবে না। আজ থেকে শুরু হলো আমাদের জীবনের নতুন পথ চলা। আর কথা নয়। বাড়ী চলো এবার।









Comments

0 comments